কভিড-১৯ প্রভাবে আর্থিক মন্দায় ব্রিটেন

স্বাভাবিক সময়ে একটি দেশের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধির সুবাদে দেশটির জিডিপিও বাড়তে থাকে। যার প্রভাবে সেদেশের নাগরিকদের আয় বাড়ে ও গড় হিসাবে তারা আরও কিছুটা ধনী হয়ে ওঠে। 

কিন্তু এমন কিছু সময় আসে, যখন এই চিত্র উল্টে যায়। তখন উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মূল্য কমতে থাকে, যার ছাপ পড়ে পুরো দেশের অর্থনীতিতে। কয়েক প্রান্তিক ধরে এমনটা ঘটতে থাকলে অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসে। 

ব্রিটেনের অর্থনীতি বিগত ১১ বছরের মধ্যে প্রথমবার এমন মন্দার সম্মুখীন হয়েছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারিতে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

সম্প্রতি ব্রিটেনের পরিসংখ্যান দফতর অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকসের (ওএনএস) প্রকাশিত উপাত্তে দেখা যায়, দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক উৎপাদন ২০.৪ শতাংশ কমেছে। কভিড-১৯ মহামারির কারণে এ সময় দেশটিতে লকডাউন চলছিল। ১৯৫৫ সাল থেকে প্রান্তিককালীন জিডিপির তথ্য সংগ্রহ করছে ব্রিটেন। এ সময়ের মধ্যে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকেই সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক পতন হয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্রিটিশ সরকারের নেয়া লকডাউন পদক্ষেপে শিল্প খাত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেবা, উৎপাদন এবং নির্মাণ খাতেও ব্যাপক পতন লক্ষ্য করা যায়। 

পরিসংখ্যান দফতরের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ব্রিটেন যে এখন ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহৎ মন্দায় আক্রান্ত, তা পরিষ্কার।’

  • (চলতি বছর পুরো বিশ্বে সামগ্রিকভাবে জিডিপির ব্যাপক পতন হবে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে ভুক্তভোগী হবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। দেশ দুটির জিডিপি কমবে যথাক্রমে আট এবং ১০.২ শতাংশ। চলতি বছর সব মিলিয়ে বৈশ্বিক জিডিপি কমবে ৪.৯ শতাংশ; যা ১৯৩০ সালের গ্রেট ডিপ্রেশনের পর সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দা ডেকে নিয়ে আসবে।)

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থনীতি ২.২ শতাংশ সংকুচিত হওয়ার পর দ্বিতীয় প্রান্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্দায় প্রবেশ করল ব্রিটেন। সংজ্ঞা অনুযায়ী, টানা দুই প্রান্তিক অর্থনীতি সংকোচনের মধ্যে থাকলে তা মন্দা হিসেবে ধরে নেয়া হয়। ২০০৮ সালের পর এবারই প্রথম ব্রিটেন মন্দাগ্রস্ত হলো। ওএনএসের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়েছে, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাস ব্রিটিশ অর্থনীতির সংকোচন মাত্রা স্পেনের ২২.৭ শতাংশের তুলনায় কিছুটা কম ছিল; কিন্তু তা যুক্তরাষ্ট্রের ১০.৬ শতাংশের তুলনায় দ্বিগুণ সংকোচন। এপ্রিলে উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে যাওয়াই মূলত অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। সেবা, উৎপাদন, নির্মাণ- সব খাতেই উৎপাদন কমেছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছর পুরো বিশ্বে সামগ্রিকভাবে জিডিপির ব্যাপক পতন হবে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে ভুক্তভোগী হবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। দেশ দুটির জিডিপি কমবে যথাক্রমে আট ও ১০.২ শতাংশ। চলতি বছর সব মিলিয়ে বৈশ্বিক জিডিপি কমবে ৪.৯ শতাংশ; যা ১৯৩০ সালের গ্রেট ডিপ্রেশনের পর সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দা ডেকে নিয়ে আসবে।

ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী রিশি সোনাক এক বিবৃতিতে বলেন, ‘যে উপাত্ত আমাদের হাতে এসেছে, তাতে এটি নিশ্চিত- কঠিন সময় চলে এসেছে। হাজার হাজার লোক এরই মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন। আরো দুঃখজনক হলো- আগামী মাসগুলোয় আরো অনেকে কাজ হারাবেন। তবে আমাদের যখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে, তখন জনসাধারণকে আশ্বস্ত করছি, একজনকেও আশাহীন, সুযোগহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে না।’ 

এদিকে গত বছরের শেষের দিকের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সম্মিলিতভাবে ব্রিটেনে অর্থনৈতিক উৎপাদন কমেছে ২২.১ শতাংশ। জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির তুলনায় যা বড় পতন। করোনাভাইরাসে মৃত্যুর দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় (১০.৬ শতাংশ) দ্বিগুণ উৎপাদন কমেছে এখানে।

ধনী অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-৭ এর বাকি দেশগুলোর জিডিপি সংকোচনের হার ব্রিটেনের তুলনায় কম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কানাডার পরিসংখ্যান দফতর থেকে বলা হয়েছে, আগের প্রান্তিকের তুলনায় জিডিপি ১২ শতাংশ সংকুচিত হবে। অন্যদিকে রয়টার্সের জরিপে অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, জাপানের অর্থনীতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৭.৬ শতাংশ সংকোচিত হবে।

এখন প্রশ্ন হলো- অন্যদেশগুলোর তুলনায় ব্রিটেনের অর্থনীতি কেন এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো? অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর দ্রুত লকডাউন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; কিন্তু যুক্তরাজ্য এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব করেছে। দেশটিতে ইতালির দুই সপ্তাহ পর, স্পেনের ১০ দিন পর ও ফ্রান্সের এক সপ্তাহ পর লকডাউন কার্যকর হয়েছে। ফলে এখানে বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে; যা নিয়ন্ত্রণে আনতেও অন্য দেশের তুলনায় বেশি সময় লেগেছে। ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়।

অন্য ইউরোপীয় দেশে লকডাউন দ্রুত তুলে নিতে পেরেছে, ফলে সেখানে অর্থনৈতিক কার্যক্রম তাড়াতাড়ি শুরু হয়েছে। উদাহারণ হিসেবে বলা যায়, মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ইতালিতে রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে ও সেলুন খোলার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু ব্রিটেনকে এজন্য ৪ জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। জার্মানিতে বইয়ের দোকান, বাইকের দোকান ও গাড়ির ডিলারশিপের মতো কিছু দোকান ২০ এপ্রিলের দিকে খুলে দেয়া হয়। ফলে এসব দেশের অর্থনীতি ব্রিটেনের অনেক আগে থেকে সচল হয়।

অন্যদিকে ব্রিটেনের অর্থনীতি সেবা খাত ও ঘরোয়া ব্যয়ের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ দুটি খাতই ভয়াবহ পতনের সম্মুখীন হয়। এছাড়া মহামারির অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ ব্যয় কমিয়ে অর্থ সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত মার্চে ব্রিটেনে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সাত লাখ ৩০ হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছেন। দেশটিতে তরুণ, বৃদ্ধ, এমনকি আত্মনির্ভর ব্যক্তিরাও এখন বেকারত্বের সংকটে রয়েছেন। 

ব্রিটিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারণা করছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বেকারত্ব বেড়ে সাড়ে সাত শতাংশে দাঁড়াবে; যা বর্তমানে ৩.৯ শতাংশ। 

তবে আশার কথা হচ্ছে, লকডাউন শিথিলের পর থেকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। যার সুবাদে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটছে। এপ্রিলে সংকোচনের পর মে মাসে অল্প প্রবৃদ্ধি ও জুনে অভাবিত ৮.৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে দেশটিতে আবারো কর্মচাঞ্চল্য শুরু হওয়ায় অর্থনীতিতে দ্রুতগতিতে পুনরুদ্ধার ঘটবে বলে আশা করা যাচ্ছে। 

ব্রিটিশ পরিসংখ্যান দফতরের পরিসংখ্যানবিদ জনাথন অ্যাথিও এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিভিন্ন খাত ঘুরে দাঁড়ানোর কারণে জুন থেকে অথনীতি আবার উজ্জীবিত হচ্ছে। তবে এ বিষয়টি বাদ দিলে জুনের জিডিপি ফেব্রুয়ারির তুলনায় অনেক কম। সার্বিকভাবে দ্বিতীয় প্রান্তিকে উৎপাদনশীলতা এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে কমে গেছে।’ 

অর্থনীতিকে পুনরায় উজ্জীবিত করে তুলতে সরকারও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ব্যাপকহারে কর্মী ছাঁটাই প্রতিরোধে কর্মসহায়ক স্কিমে হাজার হাজার কোটি পাউন্ড ব্যয় করা হচ্ছে। কার্যক্রম গ্রহণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রণোদনা কর্মসূচিতে কয়েক হাজার কোটি পাউন্ড নগদ অর্থ ঢেলেছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড (বিওই)। মূল সুদের হার রেকর্ড পরিমাণ কমিয়ে ০.১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, আগামী বছর জিডিপি ৯ শতাংশ বাড়বে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //